বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অাড়ালে মুসলিম সভ্যতার অবদান

0
2209

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অাড়ালে মুসলিম সভ্যতার অবদান

আধুনিক সভ্যতার যাবতীয় অগ্রগতির মূলে আছে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কার। আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞান হলো, বিশেষ জ্ঞান। আর এই বিশেষ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে প্রকৃতির রহস্য উম্মোচন করে মানবকল্যাণে নতুন নতুন আবিষ্কারের পথ সৃষ্টি করতে মুসলিম সভ্যতা বিশাল অবদান রেখেছেন।বিশ্ববিখ্যাত­ ঐতিহাসিক গীবন বলেন যে, লন্ডনের রাস্তা যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো তখন মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল তীর্থকেন্দ্র ‘কর্ডোভার রাজপথ’ আলোয় উদ্ভাসিত থাকতো। সেই মুসলিম বিজ্ঞানীদের সেরা ৫ টি আবিষ্কার নিয়েই অাজকের লেখা:

১) কফি :

প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে কফি না হলে যেন চলেই না। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতিদিন ১.৬ বিলিয়ন কাপ কফি পান করা হয় যেটা কিনা ৩০০ টি অলিম্পিক সাইজের পুল ভরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর অলিম্পিকের পুলের সাইজ এর দৈর্ঘ্য,প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৫০, ২৫ এবং ২ মিটার।

দারুণ জনপ্রিয় এই পানীয় তৈরি হয় কফি বিনস থেকে। বলা হয়ে থাকে কফি এসেছে ইথিওপিয়া থেকে। যেখানে কফির গাছ সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে পানীয় হিসেবে সর্বপ্রথম ইয়েমেনে এর প্রচলন শুরু হয়।

১৪০০ সালের দিকে ইয়েমেনের মুসলিম সমাজে কফি সর্বপ্রথম জনপ্রিয়তা পায়।ইথিওপিয়ায় ‘খালিদ’ নামের এক মেষপালক হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তার মেষগুলো অজানা এক প্রকার গাছের পাতা খেয়ে সতেজ হয়ে উঠছে। এটা দেখে নিজের উপর একটা পরীক্ষা করলেন তিনি।মেষপালক সেই পাতা খেলেন এবং লক্ষ্য করলেন এর ফলে তার ক্লান্তি দূর হয়ে সতেজ ভাব লাগছে । এরপর থেকে কফির দানা গরম পানিতে দিয়ে পান করার ব্যপারটা ইয়েমেনে প্রচলিত হয়ে পরে।আর এভাবেই উদ্ভব হয় বর্তমান পৃথিবীর খুবই জনপ্রিয় একটি পানীয়, কফি ।

ইয়েমেনে কফি প্রচলনের পর মাত্র ৫০ বছরেই অর্থাৎ ১৭০০ সালে শুধুমাত্র লন্ডন শহরেই ৫০০ এবং সারা ইংল্যান্ডে প্রায় ৩০০০ কফিহাউজ গড়ে উঠেছিল।মুসলিমদের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই পানীয়টি নিঃসন্দেহে মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন আবিস্কার ।

২)অ্যালজেব্রা:
ছোটবেলায় অামরা প্রথম যখন ‘অ্যালজেব্রা’নামটি শুনেছি,তখন অামার মত অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল,এটি হতে পারে জেব্রা বিষয়ক কোন কিছু !আসলে কিন্তু তা নয়,অালজেব্রা হচ্ছে বীজগনিত (অালজেব্রা একটি অারবি শব্দ, এর অাভিধানিক অর্থ সমাপ্তি বা পুনঃস্থাপন)। প্রাথমিক দিকে এর উৎপত্তি ঘটেছিল মধ্যপ্রাচ্যের মেসোপটেমিয়ায়।এর প্রথম উদ্ভব হয় গণিতবিদ মুসা আল-খোয়ারিজমির হাত ধরে।

ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয় যে সময়কে ঐ সময়ের প্রথম দিকেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন আল খোয়ারিজমি।মুসলিম মনীষীরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার দিকে ধাবিত হন,তখন খারিজমিই পথ দেখিয়েছেন তাদের।খোয়ারিজমিকে তাই স্বর্ণযুগের একজন কারিগর বললেও বেশি বলা হবে না।

তাঁর লেখা ‘আল কিতাব আল মুখতার আল হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ বইটি প্রকাশিত হয় ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে,যার নাম থেকে উৎপত্তি হয় আলজেব্রা শব্দটির। এর মূল কপি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।বইটিতে তিনি বীজগণিতের বিভিন্ন মৌলিক দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

আল খারিজমি তার বইটিতে বহুপদী সমাধানের নিয়ম একেবারে মৌলিকভাবে ব্যাখ্যা করেন এবং দ্বিঘাত পর্যন্ত সমাধানের নিয়ম আলোচনা করেন। তার এই বইটি ছিল গণিতের আধুনিকায়নের দিকে অগ্রযাত্রার এক বড় নিয়ামক।

গাণিতিক সংখ্যার বাইরে বিভিন্ন প্রতীকের মাধ্যমে অংক ধারনা তার মাথা থেকেই আসে।আল খোয়ারিজমিই প্রথম ব্যাক্তি যিনি সংখ্যার উপর ’পাওয়ার’ এর প্রচলন শুরু করেন। অালখোয়ারিজমি কে তাই বীজগণিতের জনক বলা হয়।

৪) বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় :

পৃথিবীর সর্বপ্রথম সনদ বিতরণকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফাতিমা আল-ফিহরির নামটি ইতিহাসের পাতায় অবস্থান করছে।গ্রিনিস বুক অফ রেকর্ড অনুযায়ী এ বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের প্রাচীনতম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণের মধ্য দিয়ে ফাতিমা অাল ফিহরির লক্ষ্যের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা বোঝা যায়।ফাতিমার গভীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল, তাই তিনি প্রথম থেকেই মসজিদের পাশে জমি কিনে এর পরিসর বৃদ্ধি করেন। পুরো পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করার জন্য যতটুকু অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন ছিল তা তিনি ব্যয় করেন।

৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের রমজান মাসে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রায় দুই বছর পর পুরো কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন রোজা রাখলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে মসজিদ নির্মাণ শেষ করেছিলেন এবং এতে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল তা, মধ্যযুগে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হল।
বিশ্বে উচ্চতম শিক্ষা প্রচলনে আল ফিরহির এ অবদান আজও মুসলিম নারীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

৫) মিউজিক :

মুসলিম মিউজিশিয়নরা ইউরোপের মিউজিকে দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এমনকি তখনরকার ওয়েষ্টার্ন ইউরোপের শাসকেরা বাগদাদ এবং কর্ডোবার মিউজিকের সাথে প্রতিযোগিতা করতে চেয়েও পারেনি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যেসব বাদ্যযন্ত্র এসেছে তাদের মধ্যে এমন কিছু যন্ত্র ছিলো, ধারণা করা হয়, এগুলো থেকেই ভায়োলিনের উৎপত্তি। আধুনিক মিউজিকের অনেক স্কেলও আরবী বর্ণ থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়।

এক হাজার সালের দিকে ইবনে আল-হাইথাম তাঁর যুগান্তকারী “বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি” ব্যবহারের মাধ্যমে অপটিক্স গবেষণা শুরু করেন।তিনিই সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রীক ধারণাঃ “আলো চোখের মধ্যে থেকে আসে এবং বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আবার চোখে ফিরে আসে” এটি ভুল প্রমাণ করেন। চোখ কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে তিনি আরো গভীরভাবে অনুসন্ধান করেন। আলো কিভাবে চোখে প্রবেশ করে, ফোকাস হয়, এবং আবার চোখের পেছন দিকে অভিক্ষিপ্ত হয় সে ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত ধারণা দেন। মানুষের চোখের সাথে সাদৃশ্য রেখেই তিনি সর্বপ্রথম ক্যামেরা নিয়ে কাজ করেন।অতি ক্ষুদ্র ছিদ্রবিশিষ্ট একটি বক্স; বক্সের যে পাশে ছিদ্রটি অবস্থিত সেপাশে বক্সের বাইরে যা আছে তার আলো এই ছিদ্র দিয়ে বক্সের ভেতরে প্রবেশ করে এবং বিপরীত পাশে উল্টা চিত্র অভিক্ষেপ করে।ইবন আল-হাইথাম এই ক্ষুদ্র ছিদ্রবিশিষ্ট ক্যামেরা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সুতরাং,বর্তমান বিশ্বের অনেক শিক্ষার ভিত্তি রচিত হয়েছিলো মুসলমানদের দ্বারাই।

Facebook Comments