আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। শক্তি, সামর্থ্য, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ সারা বিশ্বে পাওয়া যাবে না। বলা হয়ে থাকে, “যে জাতির যত বেশি সুশিক্ষিত জনবল আছে, সে জাতি তত বেশি উন্নত।” যৌক্তিক কারণেই আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা উন্নত ও অত্যাধুনিক তা প্রতি বছরের Scholarship Application এর পরিসংখ্যানই বলে দেয়।
স্কলারশিপ এর ধরন:
আমেরিকায় সাধারণত ২ পর্যায়ে স্কলারশিপ দেয়া হয়।
১। মাস্টার্স পর্যায়ে
২৷ পিএইচডি পর্যায়ে
আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে কিছু স্কলারশিপ দেয়া হয়। তবে তার সংখ্যা নিতান্তই কম। আর খরচও অনেক বেশি। তাই খুব কম স্টুডেন্টই আন্ডার গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে স্কলারশিপ পায়।
মাস্টার্স পর্যায়ে সাধারণত ফান্ড কম থাকে। তাই স্টুডেন্টদের নিজের খরচেই পড়তে হয়। যা প্রায় বেশিরভাগ স্টুডেন্টদের জন্যই অসম্ভব।এক এক সেমিস্টারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফি ১০-১২ হাজার ডলার এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ফি ২০-২৫ হাজার ডলার। তাই মাস্টার্স এর স্কলারশিপ ও অনেক বেশি থাকে। মাস্টার্স পর্যায়ে পরিশ্রমও অনেক কম হয়।
প্রতিবছর আমেরিকান সরকার হাজার হাজার ডলার খরচ করে গবেষণারজন্য । তাই পিএইচডি পর্যায়ে যারা যায় তাদের ফান্ড পেতে কোন অসুবিধাই হয় না। তাই পিএইচডি স্কলারশিপ পাওয়াও খুব কষ্ট। দেখা যায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০-৪০০ জন মাস্টার্স স্টুডেন্ট থাকলে পিএইচডি স্টুডেন্ট থাকে ১৫-২০ জন।
অনেকেই ধারণা পিএইচডি করার আগে মাস্টার্স করতেই হবে। অন্তত আমেরিকার জন্য তা প্রযোজ্য নয়। কারণ আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি করার আগে ২-৩ বছরের কোর্স করিয়ে নেয়। বাকি ৩ বছর গবেষণার পরে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়। তাই মাস্টার্স করে টাকা খরচ করার দরকার নেই।
ভর্তি প্রক্রিয়া:
সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে আবেদন করতে হয়।
প্রয়োজন হবে-
১. (Statement of Purpose)নামের একটি রচনা।
২. রেকমেন্ডেশন লেটার
৩. টোফেল স্কোর
৪. GRE/GMATE স্কোর
স্টেটমেন্ট অফ পারপাস:
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাস্টার্স বা পিএইচডি স্কলারশিপ এর জন্য আবেদন করতে হলে (Statement of Purpose)বা সংক্ষেপে SOP নামের একটি ছোট রচনা সংযুক্ত করতে হয়। এটি হচ্ছে ১.৫ থেকে ২ পৃষ্ঠার একটি রচনা যার মধ্যে আপনি নিজেকে, নিজের উদ্দেশ্য-লক্ষ্যকে তুলে ধরবেন। আপনার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিষয়ে আগ্রহ, কেন আগ্রহ তা নিয়ে সংক্ষেপে বর্ণনা করবেন। তবে আমাদের বাংলাদেশের স্টুডেন্টদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমরা অপটুতার দরুন Myself টাইপের রচনা লিখে দেই। অনভিজ্ঞ হাতের লেখা SOP স্টুডেন্টকে খুব একটা বেশি দূর নিয়ে যেতে পারে না।
আমাদের স্টুডেন্টদের আরো একটা বাজে টেন্ডেন্সি হল- কোন বড় ভাইয়ের SOP কপি করে তুলে দেয়া। আপনি কয়েকটি SOP দেখে ধারণা নিতে পারেন। কিন্তু কখনোই কপি করবেন না। যারা ভর্তি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত আছে তারা খুব সহজেই এগুলো ধরতে পারে। ফলে এই ধরনের SOP গুলোর জায়গা হয় আস্তাকুড়ে।
SOP লেখার সময়ে এই দিকগুলো লক্ষ্য রাখবেন-
১. SOP লেখার আগে ভালো প্রস্তুতি নিন। কখনোই তাড়াহুড়ো করে SOP লিখবেন না। কমপক্ষে ১মাস হাতে সময় নিন।
২. আপনার SOPতে এই কয়টি বেসিক ইনফরমেশন গুলো থাকতেই হবে-
(i) (Introduction) আপনার নিজের সম্পর্কে বলুন। আপনার আগ্রহ, উদ্দেশ্য নিয়ে বলুন। কোন বিষয়ে
আপনি পড়তে চান বা গবেষণা করতে চান এবং এর জন্য যৌক্তিক কারণ প্রদর্শন করুন।
(ii) আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে লিখুন। শিক্ষা জীবনের কোন দিকটি আপনাকে এই বিষয়ের প্রতি
অনুপ্রেরণা দিয়েছে বলুন।
(iii)আপনার কাঙ্খিত গবেষণা ও এটি নির্বাচনের কারণ স্পষ্ট করে বলুন।
(iv)কেন আপনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান বা গবেষণা করতে চান বলুন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন দিক
আপনাকে আকর্ষণ করে তা ফোকাস করুন।
(v) আপনার উদ্দেশ্য,লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি আলোকপাত করে নিজেকে এই স্কলারশিপের জন্য একজন
সুযোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চমৎকারভাবে ফিনিশিং করুন।
৩. SOP ৫-৬টি অনুচ্ছেদেই শেষ করা ভাল। ১.৫-২ পৃষ্ঠার মধ্যে। এর চেয়ে বেশি হলে পড়ার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়।
৪. Standard Font ও Font size ব্যবহার করবেন।
৫. SOPতে যেন কোন Grammatical ভুল বা বানান ভুল যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। কারণ এগুলো চোখে পড়ে বেশি।
৬. Draft তৈরি করুন। ভুলগুলো খুজে বের করুন। Expert দের দিয়ে Review করান।
৭. অবশ্যই Print copy জমা দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় সময় হাতে নিয়ে SOP লিখুন। বারবার চেক করুন। ভুলগুলোখুজে বের করুন। বারবার সংযোজন বিয়োজন করুন যতক্ষণ আপনি সন্তুষ্ট না হন। দ্রুত সন্তুষ্ট না হওয়ার চেষ্টা করুন। SOP একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্কলারশিপের জন্য। একটি ভাল SOPই পারে সারা বিশ্বের হাজার হাজার স্টুডেন্টদের মধ্যে আপনাকে অনন্য করে তুলতে।
রেকমেন্ডেশন লেটার:
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের জন্য একটি অপরিহার্য অংশ হচ্ছে রেকমেন্ডেশন লেটার। এটি সাধারণত একজন শিক্ষক যিনি এই ছাত্রকে খুব নিবিড়ভাবে দেখেছেন, তাকে ভালোভাবে চেনেন, জানেন তিনি ছাত্রের লেখাপড়ার মান, গবেষণা করার যোগ্যতা, সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষকে একটি ধারণা দিয়ে একটি চিঠি লিখে পাঠান। বাংলাদেশের স্টুডেন্টরা সাধারণত যে শিক্ষকের কাছে থিসিস করে, তার কাছে থেকে রেকমেন্ডেশন লেটার নেন।
রেকমেন্ডেশন লেটার স্কলারশিপ এর জন্য একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ন্যূনতম সিজিপিএ-এর ব্যবধানে থাকা স্টুডেন্টদের মধ্যে এটি তখন প্রধান ব্যবধায়ক হয়ে ওঠে।
একটি ভাল রেকমেন্ডেশন লেটারে থাকা উচিত স্টুডেন্টটির কাঙ্খিত বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা আছে, সে কতটা সৃজনশীল, তার ঐ বিষয়ে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কত, তার সমাধান গুলো কতটা ইন্টারেস্টিং, তার গবেষণা করার যোগ্যতা, গবেষণায় তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা, সে কতটুকু অধ্যবসয়ী ইত্যাদি।
তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের রেকমেন্ডেশন লেটারে বেশ কিছু সমস্যা থাকে। যেমন-
১. বাংলাদেশের শিক্ষকেরা অনেকেই রেকমেন্ডেশন লেটার লিখতে চান না। ফলে ছাত্রকে নিজেই লিখতে হয়। অনভিজ্ঞ হাতের লেখা সুপারিশে শুধু ছাত্রের সুনাম করা থাকে যা খুব সহজেই ধরা পড়ে কতৃপক্ষের। ফলে পুরো আবেদনটিই বৃথা যায়।
২. অনেক শিক্ষক আবার একই রেকমেন্ডেশন লেটার কপি করে অনেক স্টুডেন্টদের দেন। এটিও খুব সহজেই ধরা পড়ে কতৃপক্ষের হাতে।
৩. বাংলাদেশের অনেক শিক্ষকই জানেন না যে কিভাবে রেকমেন্ডেশন লেটার লিখতে হয়। ফলে উপযুক্ত কথা না লিখে অপ্রাসঙ্গিক কথা চলে আসে। ফলে আবেদনটি ব্যর্থ হয়।
কেবলমাত্র একটি ভাল রেকমেন্ডেশন লেটারের জোরে একজন দুর্বল স্টুডেন্ট ভাল স্কলারশিপ পেতে পারে। আবার বাজে রেকমেন্ডেশন লেটার এর জন্য ভাল সিজিপিএ ওয়ালা স্টুডেন্টের স্কলারশিপই হয় না।
আমেরিকার অনেক বড় কোম্পানিতে সিজিপিএ-এর প্রয়োজন হয় না। তাদের ধারণা, মেধার মান সিজিপিএ করতে পারে না। এক্ষেত্রে আবেদনকারীর মেধার মান নির্ধারণ করে রেকমেন্ডেশন লেটার। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকমেন্ডেশন লেটার শুধু স্কলারশিপের জন্য নয়, যেকোন পর্যায়েই অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
চলবে…….